সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজি) বেনজীর আহমেদের আরো ১১৯টি দলিলের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আবেদনে রবিবার ঢাকা মহানগর আদালতের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। আদালতের আদেশটি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর মাহ্মুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।
মাহ্মুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১১৯টি দলিরের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ হয়েছে।
এই স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আছে গুলশান আবাসিক এলাকার বি ব্লকে ১৩৪ (পুরাতন ১৩০) নম্বর রাস্তার ১ নম্বর প্লটে একই ভবনে ৪টি ফ্ল্যাট। দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ২৪২ দশমিক ৯৯ বর্গফুট। অন্য দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৩৫৩ দশমিক ৪০ বর্গফুট। বাকি ১১৫টি তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মধ্যে সাভারে ১টি।
বাকি ১৪টি মাদারীপুরের রাজৈড়ে। এগুলো বেনজীর আহমেদের স্ত্রীর নামে কেনা। অস্থাবর সম্পদের আছে বেনজীর আহমেদের নামে ৩০ লক্ষ টাকার একটি সঞ্চয়পত্র এবং তিন মেয়ের নামে তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট। এ ছাড়াও বেনজীর আহমেদ ও উনার পরিবারের শতভাগ মালিকানাধীন চারটি কম্পানি এবং ১৫টি কম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ৮৩টি দলিলের স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন এই আদালত। ওইদিনের আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৮৩টি দলিলে জমি প্রায় ১১৪ একর। এর মধ্যে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে অন্তত ৮১ একর। বেনজীরের নিজের নামে রয়েছে ৭.৬০ একর। বাকি প্রায় ২৬ একর জমি তার তিন মেয়ে ও কয়েকজন স্বজনের নামে রয়েছে।
তবে ৩৩টি ব্যাংক হিসাবে কত টাকা জমা আছে, সে হিসাব আদালতের আদেশ থেকে পাওয়া যায়নি।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুসন্ধান চলাকালে বেনজীর আহমেদ কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের নামে আরো সম্পত্তির তথ্য আসলে সেগুলোর কী করা হবে, সে বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দিবে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব।’
‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। এরপর গত ২ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে দ্বিতীয় দফার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এতে কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল আইনি নোটিশ দেন তিনি। নোটিশে স্বউদ্যোগে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয় কমিশনের চেয়ারম্যানকে। তাতে সাড়া না পেয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটে বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়।
গত ২৩ এপ্রিল এই রিট শুনানিতে ওঠে। শুনানিতে দুদকের আইনজীবী জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। পরে হাইকোর্ট অনুসন্ধান কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলে আদেশ দেন।
এ অবস্থায় গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের নির্দেশনা চেয়ে সংস্থাটির অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম আবেদন করলে আদালত সেই আদেশ দেন।
আদালত আদেশে বলেন, ‘বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না। অতএব অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এ ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, বিধিমালা-২০০৭-এর ১৮ বিধি অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হলো।’
আদেশে আরো বলা হয়, স্থাবর সম্পদের ওপর জব্দের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই তা হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না। আর অস্থাবর সম্পদে অবরুদ্ধের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় ব্যাংক হিসাবগুলোতে অর্থ জমা করা যাবে, কিন্তু উত্তোলন করা যাবে না। আদেশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রচারের নির্দেশ দেন আদালত। এ জন্য আদেশের অনুলিপি কমিশনের সচিবের কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া আদেশের অনুলিপি কমিশনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক, বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিসের উপপরিচালক, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, টেকনাফ, উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), সাবরেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।