শাবিপ্রবির যে অধ্যাপক ‘মাদার অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক’ হিসেবে পরিচিত

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক আমিনা পারভীন। বিভাগটিতে প্রবেশ করলেই শিক্ষার্থীদের কাছে মাদার অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক নামে যিনি বেশি পরিচিত। তবে নিজ বিভাগেই কেবল নয়, এই নামটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কাছেও বেশ পরিচিত।

বর্তমানে অধ্যাপক আমিনা পারভীন শাবিপ্রবির প্রথম নারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শুক্রবার(৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দেশের ‘নারীর ক্ষমতায়নে সফলতার অগ্রসর’ হিসেবে শাবিপ্রবির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিনা পারভীনের গল্প উঠে এসেছে। আজ শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ইউএনবিকে নিজের গল্প বলেছেন শাবিপ্রবির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিনা পারভীন।

জন্মের সাতদিন বয়সেই বাবাকে হারান অধ্যাপক আমিনা পারভীন। আমিনা পারভীনের পিতা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে অধ্যাপক আমিনা পারভীন ছোট এবং বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগ হতে কৃতিত্ত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে মলিকুলার বায়োসায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় জন্ম ও বেড়ে উঠা আমিনা পারভীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

এছাড়া, ২০০৭ সালে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স অফ সাইন্স ইন সোশাল ওয়ার্ক (আইএমএসএসডব্লিও) ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল শাবিপ্রবির সমাজকর্ম বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।

অধ্যাপক আমিনা পারভীন শাবিপ্রবির শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি, হল প্রাধ্যক্ষ, সিন্ডিকেট সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা, সমাজকর্ম বিভাগের প্রধানসহ প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বকালেই রাষ্ট্রীয়ভাবে আরেকটি নতুন দায়িত্ব চলে আসে। তিনি শাবিপ্রবির প্রথম নারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে চেয়ারটির দায়িত্ব সফলভাবেই পালন করছেন।

শাবিপ্রবির সমাজকর্ম বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ১৩-১৪ সেশনের ফাহমিদা খান ঊর্মি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পর প্রথম যেদিন ওরিয়েন্টেশন হয় সেদিন সকল শিক্ষকদের মধ্যে একজন শিক্ষকের কথাগুলো বেশ মনোযোগ কাড়ল। খুবই মিষ্টি করে, আদর করে কথা বলছিলেন। তার কিছুদিন পরেই আমি একটি দূর্ঘটনায় পতিত হই। রাতে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকাল হতে না হতেই দেখি সেই মমতাময়ী চাহনির মানুষটা আমাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন।’

তিনি আরও বলেন, তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক আমিনা পারভীন। কারোর কোনো অসুবিধা বা সমস্যায় যিনি মাতৃরূপে আবির্ভূত হতেন তিনি আমাদের আমিনা পারভীন। আমাদের অধ্যয়নের সময় থেকেই দেখে এসেছি বিভাগের পাশাপাশি নানা দাপ্তরিক কাজে বিভিন্ন সময় তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তারপরও তার সর্বোচ্চ প্রাধান্য তার শিক্ষার্থীরা। তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাকে ডাকেন ‘মাদার অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক’ বলে। আদতে তিনি শুধু সমাজকর্মের না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর ভরসার এবং আস্থার জায়গা।

সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘কোনো প্রয়োজনে তার কাছে গিয়ে কেউ কখনও অখুশি হয়ে ফিরেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। তার দৃঢ় চিত্ত, আপসহীনতা, অটল বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কেবল শিক্ষকই না, আমাদের ‘মা’ যেনো আমাদের মাথার উপরে তার স্নেহের পরশ রেখে যান। আলো জ্বালিয়ে যান।’

বিভাগটির আরেক সাবেক শিক্ষার্থী কয়েস মিয়া বলেন, ‘অধ্যাপক আমিনা পারভীন; সাহসিকতা, স্থিরতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার এক অপূর্ব সম্মেলন। অধ্যাপক আমিনা পারভীন ম্যাম একসময় সমাজকর্ম বিভাগের একান্ত নিজস্ব আলোকবর্তিকা হিসেবে গণ্য হলেও একসময় সেই আলো উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে ৩২০ একরের প্রতিটি ইঞ্চিতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমাজকর্ম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক ভিসিমরহুম অধ্যাপক হাবিবুর রহমান স্যারের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সমাজকর্ম বিভাগের মুখপাত্র হয়ে ম্যাম পালন করে যাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সব দ্বায়িত্ব। বর্তমানে দ্বায়িত্ব পালন করছেন শাবিপ্রবির প্রথম নারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে এবং গড়েছেন এক অনন্য নজির।’

কয়েস মিয়া বলেন, ‘এই প্রশাসনিক পরিচয়ের বাইরেও সমাজকর্ম বিভাগের একজন ছাত্র হিসেবে আমরা ম্যামের কোমল, মমতাময়ী মাতৃরুপের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। ম্যাম বিভাগের শিক্ষার্থীদের সন্তানতুল্য স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন সবসময়। আমরা ম্যামকে চিনি ‘সমাজকর্ম বিভাগের মা’ হিসেবে।’

বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২০-২০২১ সেশনের আয়াছ চৌধুরী বলেন, আমিনা পারভীন ম্যাম একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। আমি ২০২২ সালে সমাজ কর্ম বিভাগে ভর্তি হই এরপর থেকে ম্যামকে খুব কাছ থেকে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুরুদায়িত্বে ম্যাম অনেক বেশি ব্যস্ত থাকলেও সবসময় ছাত্র -ছাত্রীদের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখেন। আমাদের কিভাবে ভালো হয় সেসব বিষয়ে চিন্তা করেন। ম্যাম এর ছোট ছোট পরামর্শ, স্নেহ – ভালোবাসা আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।

শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা, নিজের দায়িত্ব পালন এবং সফল নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ- বিষয়ে অধ্যাপক আমিনা পারভীন বলেন, ‘সফলতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমি কতটা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি তার মূল্যায়ন আমার ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, তথা কর্তৃপক্ষ করবেন। তবে এটুকু বলবো আজ আমি যেখানে অবস্থা করছি, সেখানে আসার পেছনে আমার ‘মা’ এর অবদান অপরিসীম।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছোটোবেলা থেকে শিক্ষাজীবনের সব গন্ডি পেরিয়ে বর্তমান সময়ে পৌঁছাতে চারপাশের নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে। আমার মা এর যোগানো সাহসই সেসব প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিকট আমার মা এর দেখানো পথকেই অনুসরণ করেছি। একইসঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছি। আমার মনে হয় নারীর ক্ষমতায়ন নিজের ঘর থেকেই শুরু হয় এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম সোপান আমরা নারীরা কেবল আমাদের মায়ের হাত ধরেই শিখে থাকি।’

তিনি বলেন, নিজেকে তখন সফল মনে হয় যখন নিজের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে সামনে পাই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব নয়, শেষ সময় পর্যন্ত নিজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। সূত্র : ইউএনবি