রাশিয়ার মস্কোতে অবস্থিত ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে শুক্রবারের হামলা ছিল বহু বছরের মধ্যে দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরুর পর কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে বন্দুকধারীদের হামলা চালানোর এই ঘটনায় ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
যেভাবে হামলা হলো
ক্রোকাস সিটি হলটির অবস্থান মস্কো শহরের উপকণ্ঠে ও ক্রেমলিন থেকে ১২ মাইল দূরে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্দুকধারীরা যখন হামলা শুরু করে তখন সেখানে রক গ্রুপ পিকনিকের একটি কনসার্ট শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। ভিডিওতে দেখা যায়, কনসার্ট হলে ঢোকার আগে থেকেই কমপক্ষে চারজন এলোপাতাড়ি গুলি করছে।
একজন নারী বলছিলেন, যখন গুলির শব্দ শোনা যায় তখন মিলনায়তনের ভেতরে তিনিসহ অন্যরা মঞ্চের দিকে এগোচ্ছিলেন। রাশিয়ার একটি টিভিকে তিনি বলেন, ‘আমি অস্ত্রসহ এক ব্যক্তিকে দেখলাম একটি স্টলে এবং সে সময় গোলাগুলি হচ্ছিল।
তখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে একটি লাউডস্পিকারের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করি।’ তিনি জানান, এক পর্যায়ে হলের ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়। আগুন পরে সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাততলা ভবনের ওপরের দুই তলার কাঁচ উড়ে যায়।
রাশিয়ার তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘সন্ত্রাসীরা কনসার্ট হল প্রাঙ্গণে আগুন দেওয়ার জন্য দাহ্য জাতীয় তরল পদার্থ ব্যবহার করেছে। সেখানে দর্শকরা ছিল, যাদের অনেকেই আহত হয়েছে।’
পরে হেলিকপ্টার এনে ১৬০ টন পানি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও আগুন পুরোপুরি নেভাতে ১০ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। এর মধ্যে সন্দেহভাজনরা সরে পড়ে।
পুরো হামলার ঘটনাটি ছিল ২০ মিনিটের মতো। এতেই নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ এবং আহত হয়েছে আরো অনেকে। অনেকেই নিহত হয় গুলিতে। আর কিছু নিহত হয় ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে। তবে পিকনিক ব্যান্ডের সদস্যরা অক্ষত রয়েছেন।
হতাহত কারা
প্রায় ছয় হাজার রুশ ওই ইভেন্টের জন্য কনসার্ট হল কমপ্লেক্সে ছিলেন। মৃতের সংখ্যাও ঘটনার পর ক্রমাগত বেড়েছে। শনিবার দুপুর নাগাদ মৃতের সংখ্যা ১৩৩ জন বলে নিশ্চিত করা হয়। হতাহতের যে সরকারি তালিকা সেখানে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির বয়স ৭০-এর বেশি। ওই নারী তিন সন্তানসহ মারা গেছেন।
নিহতদের পাশাপাশি কমপক্ষে আরো ৬০ জনের অবস্থা গুরুতর এবং কর্তৃপক্ষ আরো মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
নিহত ও আহতদের অনেকেই এসেছিলেন ক্রাসনোগর্স্ক, খিমকি এবং নিকটবর্তী মস্কোর উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় আরো কয়েকটি শহর থেকে।
হামলাকারীরা কারা
মনে হচ্ছে, যারা এই হামলা চালিয়েছে তারা আগুন এবং নিজেদের তৈরি করা হাঙ্গামা থেকে বাঁচিয়েছে। এরপর তাদের সন্ধানে তল্লাশি শুরু হয়।
রুশ এমপি অ্যালেক্সান্ডার খিনশটেইন বলেছেন, হামলাকারীরা একটি সাদা রঙের রেনল্ট গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। তিনি জানান, পুলিশ ব্রিয়নস্ক অঞ্চলে গাড়িটি থামাবার চেষ্টা করেছিল, যেটি মস্কো থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে দুজনকে আটক করা গেলেও বাকিরা পালিয়ে যায়।
গোলাগুলি শুরুর ১৪ ঘণ্টা পর রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) ১১ জনকে আটক করার কথা ঘোষণা করে, যাদের মধ্যে ‘চারজন সরাসরি জড়িত’। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এরা বিদেশি নাগরিক। অসমর্থিত সূত্রগুলো এসব ব্যক্তিদের তাজিকিস্তানের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেছে। খিনশটেইন বলেছেন, ওই দেশের পাসপোর্ট তাদের গাড়িতে পাওয়া গেছে।
হামলার পেছনে কারা
শুক্রবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইএস বলেছে, তারাই এ হামলা চালিয়েছে। শনিবার মুখে মাস্ক পরিহিত চার হামলাকারীর ছবি তারা প্রকাশ করে।
রুশ কর্তৃপক্ষ এ দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মস্কোর বড় কোনো সমাবেশে হামলা হতে পারে—যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্কতা দেওয়ার দুই সপ্তাহ পর এ দাবিটি এলো।
তবে রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি।
গত সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘রাশিয়ায় সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে কয়েকজন পশ্চিমা কর্মকর্তার উসকানিমূলক বিবৃতি হলো ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো এবং ভয় দেখানো ও সমাজকে অস্থিতিশীল করার জন্য।’
হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্র যাদের চিহ্নিত করেছে তারা হলো আইএস-খোরসান বা আইএস-কে। সংগঠনটির উদ্দেশ্যে হলো আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও ইরানজুড়ে মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ককে উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, ‘আইএস-কে রাশিয়ার ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে গত দু বছর ধরে। আফগানিস্তান, চেচনিয়া ও সিরিয়ায় মস্কোর হস্তক্ষেপের দিকে ইঙ্গিত করে আইএস-কের অভিযোগ হলো, ক্রেমলিনের হাতে মুসলিমদের রক্ত।’
তবে রাশিয়া কর্তৃপক্ষ আইএসের দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। পুতিন জানিয়েছেন, ইউক্রেনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় হত্যাকারীদের আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সীমান্তে তাদের জন্য ইউক্রেনীয়রা একটি জায়গা তৈরি করছিল।’ ইউক্রেন অবশ্য রাশিয়ার এ দাবি অসম্ভব বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।