চলছে চতুর্মুখী অভিযান

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ প্রাণহানির পর রাজধানীজুড়ে চলছে চতুর্মুখী অভিযান। গতকাল গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, খিলগাঁও, নিউমার্কেট এলাকার বহুতল ভবনের রেস্তোরাঁগুলোয় অভিযান চালিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনী। তিন দিনের অভিযানে ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

প্রয়োজনীয় লাইসেন্স, অগ্নিনির্বাপণ ও নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অগ্নিঝুঁকি নিয়ে দোকান চালানোর অভিযোগে গুলশানের বিরিয়ানির দোকান কাচ্চি ভাইয়ের একটি শাখাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া গুলশানের ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁকে ৪০ হাজার এবং সোনারগাঁও জেনারেল স্টোর নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গুলশান ও বনানী এলাকায় ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন ও মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে অভিযানে নামে ডিএনসিসি। তাতে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিস। অভিযানের শুরুতে গুলশান-২ সার্কেলের হোসেন ভবনে যান ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাঁচ তলা ওই ভবনে ‘কাচ্চি ভাই’সহ রেস্তোরাঁর সংখ্যা আটটি। কাচ্চি ভাইয়ে গিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মচারীরা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আর কিছু দেখাতে পারেননি বলে ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন জানান। বিরিয়ানির ওই দোকানে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে জুলকার নায়ন বলেন, ‘তারা ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আর কোনো বৈধ কাগজ দেখাতে পারেননি। তাদের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই, কোনো ফায়ার এক্সিট নেই। এ কারণে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আবার পরবর্তী অভিযানে কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে অসংগতি পাওয়া গেলে সিলগালা করে দেওয়া হবে। গুলশান ও আশপাশ এলাকার রেস্তোরাঁগুলোর অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে অভিযানে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গুলশানের সাত তলা সেবা হাউজ ভবনের নিচতলায় মালামাল রাখায় সোনারগাঁও জেনারেল স্টোরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি আমরা। মালামালগুলো সোনারগাঁও স্টোরের। এ ছাড়া অপ্রতুল অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ও রেস্তোরাঁর কিচেনের পরিবেশ ভালো না থাকায় ধানসিঁড়িকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের পর দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে হোটেল-রেস্তোরাঁর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের পর ধানমন্ডি, খিলগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় একই রকম অনিরাপদ পরিবেশে ভবনজুড়ে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ প্রেক্ষাপটে সমালোচনার মুখে রবিবার রাজধানীতে অভিযানে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। আবাসিক ভবনে নিয়মের বাইরে গিয়ে বানানো রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এসব অভিযানে, আবার কোনো কোনো জায়গায় গ্রেফতার ও জরিমানা করা হচ্ছে।

খিলগাঁও পল্লীসংসদ এলাকার রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ সময় চারটি রেস্টুরেন্টকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গতকাল এ উচ্ছেদ অভিযান চালান রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি বহুতল ভবনে রাজউকের নির্দেশ না মেনে রেস্তোরাঁ তৈরি এবং ফায়ার সেফটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা করা হয়। চারটি রেস্তোরাঁ থেকে মোট ৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। পরিবেশের ছাড়পত্র, ফায়ার এক্সিট পয়েন্টগুলো ঠিক আছে কি না এ বিষয়গুলো আমরা দেখছি। এ ছাড়া ভবন বাণিজ্যিক নাকি আবাসিক সেসবসহ রেস্টুরেন্ট চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সনদ আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে।’ রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন নিউ সুপার দক্ষিণ মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। অভিযানে ১৩টি দোকানকে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা এবং অপসারণ করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও ঝুঁকি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন অসংগতি সমাধানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিধিমালা ভঙ্গ করে সিঁড়িতে ভাসমান দোকান করার কারণে ১৩টি দোকানকে ৫ হাজার করে মোট ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া এসব দোকান অপসারণ করা হয়।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘এ মার্কেটের সিঁড়িগুলো হচ্ছে জরুরি বহির্গমন অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষজন নেমে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা এখানে এসে দেখেছি সব সিঁড়ি দখল করে দোকান বসানো হয়েছে। যে কোনো অগ্নিদুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস সে স্থানে পৌঁছাতে কিংবা মানুষজন নেমে যেতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করবে। সে কারণে এ জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে ১৩টি দোকানকে জরিমানা করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এদিকে টানা অভিযানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁ বন্ধ করে রেখেছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। এসব দোকানের হটলাইন নম্বরে ফোন দিয়েও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নকশা বদলে গড়ে তোলা ধানমন্ডির বিভিন্ন ভবনে অভিযান চালিয়েছে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। গতকাল সিটি কলেজের সামনের ফুটপাতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা অন্তত পাঁচটি খাবারের দোকান গুঁড়িয়ে দিয়েছে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। এতে সহযোগিতা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, রবিবার শুরু হয়ে গতকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ও কেমিক্যাল দাহ্য রাখার অভিযোগে ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ২০টি। প্রসিকিউশন দেওয়া হয়েছে ৮৮৭টি। এ তিন দিনে অভিযান চলেছে ১ হাজার ৩৪৭টি। এর মধ্যে হোটেল-রেস্তোরাঁ ১ হাজার ১৩২টি, ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রাখার দোকান ২০৭টি, কেমিক্যালের আটটি গোডাউন রয়েছে।