সাংবাদিক অভিশ্রুতির যুদ্ধ থামিয়ে দিল আগুন

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বড় সাংবাদিক হতে চেয়েছিলেন। তবে তা আর হলো না। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের নামের তালিকায় যুক্ত হয়েছে তাঁর নাম।

কুষ্টিয়ার বৃষ্টি খাতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এবং তাঁর চাকরিক্ষেত্রে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। ফেসবুকে অভিশ্রুতি বন্ধু, সহকর্মীরা তাঁকে ট্যাগ করে একের পর এক পোস্ট দিয়ে শোক প্রকাশ করে বলছেন, তাঁর এ মৃত্যুর খবর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। অনন্তলোকে তিনি যাতে ভালো থাকেন, সে কথাও লিখেছেন তাঁরা। বড় সাংবাদিক হতে পারলেন না, সে আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন সহকর্মী ও বন্ধুরা।

হাসিখুশি এবং খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেওয়া অভিশ্রুতি এখন স্রেফ একটি সংখ্যা; সামগ্রিক অব্যবস্থাপনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকার আরেকটি নাম—এভাবেই দেখছেন তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা।

আজ শুক্রবার দুপুরে প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি লাশ আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে। তখন পর্যন্ত এই লাশের পরিচয় ছিল অজ্ঞাত, অর্থাৎ লাশের দাবিদার কেউ ছিলেন না। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা লাশের আঙুলের ছাপ নিয়ে লাশটি আবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেন। তবে তার আগেই সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের একজন শনাক্ত করেন লাশটি অনলাইন পোর্টাল ‘দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ’–এর সাবেক সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর। আগুনে দগ্ধ হলেও তাঁর মুখ ও হাত পুড়ে কয়লা হয়ে যায়নি।

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের প্রধান প্রতিবেদক গোলাম রব্বানী জানালেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী তাঁদের প্রতিষ্ঠানের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক হিসেবে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ছয় মাস কাজ করেছেন।

অভিশ্রুতি নির্বাচন কমিশন বিটে কাজ করেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গোপীবাগে ট্রেনের আগুনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন করে তা ফেসবুকে নিয়মিত পোস্ট করতেন অভিশ্রুতি। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনের সামনে তোলা ছবিসহ পোস্ট করা বেশির ভাগ ছবিতেই অভিশ্রুতির হাসিমুখ।

নতুন আরেকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে যোগ দেওয়ার কথা ছিল অভিশ্রুতির। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত থাকা তাঁর সহকর্মীদের একজন জানালেন, নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়া উপলক্ষে বৃহস্পতিবার অভিশ্রুতি স্টার টেক লিমিটেডের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ তুষার হাওলাদারসহ কয়েকজন মিলে বেইলি রোডের ওই ভবনে খেতে গিয়েছিলেন। তুষার হাওলাদারও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তিনিও একই নিউজ পোর্টালের সাবেক সংবাদকর্মী ছিলেন।

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সংবাদে জানানো হয়েছে, অভিশ্রুতির গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। ইডেন মহিলা কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি।  

শুক্রবার সন্ধ্যায় অভিশ্রুতি বাবা শাবলুল আলমের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই বলে জানান। পরে কথা হয় তাঁর আত্মীয় হারুন অর রশীদের সঙ্গে। অভিশ্রুতি হলেন তাঁর ফুফাতো বোনের মেয়ে।

হারুন অর রশীদ জানালেন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে বৃষ্টি খাতুন নামেই তাঁর ভাগনির মৃত্যু সনদ পেয়েছেন। সব প্রক্রিয়া শেষে লাশ কুষ্টিয়ার খোকসায় গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বৃষ্টি খাতুন ফেসবুক এবং চাকরিক্ষেত্রে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন, এটা তাঁরা মৃত্যুর পর জানতে পেরেছেন।

অভিশ্রুতি বা বৃষ্টি খাতুনের দুই বোন খোকসায় থাকেন। মা বিউটি বেগমও মেয়েকে হারিয়ে দিশাহারা। ঢাকায় আসার মতো মনকে শক্ত করতে পারেননি। বাড়িতেই মেয়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন।

ফেসবুকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীকে ট্যাগ করে নিহাদ নামের একজন লিখেছেন, পুরান ঢাকায় আর ঘোরা হলো না। কেউ কেউ লিখেছেন, এমন ২৯ ফেব্রুয়ারি আর না আসুক, মানুষের জীবন কত সংক্ষিপ্ত আর অনিশ্চিত। একজন লিখেছেন—হায়রে জীবন, কখন কোথায় ফুলস্টপ হয় কে–ই বা জানে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কাছের বন্ধু–সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন অভিশ্রুতি। দু–এক দিন আগেও আবার দেখা হবে বলে অভিশ্রুতি বিদায় নিয়েছিলেন অনেকের কাছ থেকে।

অভিশ্রুতি বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, ভালো মানুষ হতে চেয়েছিলেন এসব কথাও ফেসবুকে লিখেছেন অভিশ্রুতির বন্ধু ও সহকর্মীরা।

প্রথম আলো নিয়েও একটি পোস্ট করেছিলেন অভিশ্রুতি। ‘প্রথম আলোর ২৫: তরুণদের ভাবনা’ শিরোনামের একটি ভিডিও পোস্ট করে গত বছর লিখেছিলেন, ‘আমাদের সকালটা হতো চা ও প্রথম আলো দিয়ে।’

প্রিতম সীমান্ত নামের একজন ফেসবুকে অভিশ্রুতির সঙ্গে কথোপকথনের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘দুই বছর পর গত পরশুই দেখা হয়েছিল, তখন অভিশ্রুতি বলেছিলেন—এত সমস্যা, তবু ভালো আছি, যুদ্ধ করে যেতে হবে।’ তবে বন্ধুরা বলছেন, অভিশ্রুতির যুদ্ধ থামিয়ে দিল আগুন।