ব্যাপক সংঘর্ষের মুখে মিয়ানমার ছাড়ার হিড়িক পড়েছে দেশটিতে। মান্দালায়ের পাসপোর্ট অফিসে পদদলিত হয়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার এই দুর্ঘটনা ঘটে। এদিকে বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণের কারণে তিন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহীদের ঠেকাতে দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমারে সব নাগরিকের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দেয় সামরিক জান্তা। সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে বাঁচতে এরপর দেশটির মানুষের মধ্যে দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়। যাদের পাসপোর্ট নেই, তারা পাসপোর্ট অফিসে ভিড় করা শুরু করেন। এমনই সোমবার মান্দালায়ে পাসপোর্ট অফিসে ঢোকার জন্য লাইন ধরেন হাজার হাজার মানুষ। সেখানেই পদদলনের ঘটনা ঘটে।
ইয়াঙ্গুনের এক ভিসা ও পাসপোর্ট এজেন্ট সংবাদমাধ্যম ইরাবতিকে জানান, গত ১০ ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার এমন ঘোষণার পর বিপুলসংখ্যক মানুষ পাসপোর্ট তৈরির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মান্দালায়ের এক বাসিন্দা যিনি পাসপোর্ট অফিসের কাছেই থাকেন তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫ হাজার মানুষ পাসপোর্টের জন্য লাইন ধরছেন। কিন্তু দিনে মাত্র ২০০টি আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। জান্তা বাহিনীর এমন ঘোষণার আগে পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না বলে জানান তিনি।
অপর এক বাসিন্দা বলেন, পাসপোর্ট অফিসে লাইন ধরার জন্য ছোট একটি জায়গা রয়েছে। কিন্তু সেখানে অনেক মানুষ ভিড় করেন। এরপর ঠ্যালাঠেলিতে পড়ে গিয়ে দুই নারী পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান। সোমবার রাত ২টার দিকে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থা জানিয়েছে, মানুষের চাপাচাপিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে তিন নারী জ্ঞান হারান। এরপর তাদের দ্রুত একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাদের মধ্যে দুই নারীর মৃত্যু হয়। নিহত দুই জনের মধ্যে এক জনের বয়স ৫২, অন্যজনের ৩৯। আহত অপর নারীর বয়স ৫৩ বছর। তিনি হাসপাতালে চিকিত্সা নিচ্ছেন। এছাড়া সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কিছু অসাধু ব্যক্তিও পাসপোর্ট অফিসে লাইনে দাঁড়াতে ভিড় করছেন। তারা আগে থেকে অপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়ান, এরপর সেই স্থানটি অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেন। শুধু এই স্থান কেনার জন্য কেউ কেউ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ কিয়াট (মিয়ানমারের মুদ্রা) খরচ করছেন।
এদিকে চীন-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত একটি শহরের দখল ছেড়ে বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণের দায়ে তিন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। এ ঘটনায় আরো তিন সেনা কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, কয়েক মাস যুদ্ধের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে শান রাজ্যের লাউক্কাই শহরের দখল ছেড়ে দিয়ে জাতিগত বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সমন্বিত গ্রুপ থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ঐ তিন সেনা কর্মকর্তা। তাদের সঙ্গে শত শত সাধারণ সেনাসদস্যও আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর বিদ্রোহী অ্যালায়েন্স জান্তা কর্মকর্তা ও তাদের সৈন্যদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। লাউক্কাই শহরটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিয়ানমার জান্তার ইতিহাসে এই আত্মসমর্পণকে অন্যতম বড় পরাজয় ও ক্ষতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সমর্থকদের মধ্যে জান্তা নেতৃত্বের প্রতি সমালোচনা আরো তীব্র হয়েছে এ ঘটনায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুটি সামরিক সূত্র জানিয়েছে, লাউক্কাই শহরের কমান্ডারসহ তিন জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া লাউক্কাইতে আত্মসমর্পণে ভূমিকা রাখার দায়ে অন্য তিন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), আরাকান আর্মি (এএ) ও তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) সমন্বয়ে গঠিত থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের দখলকৃত বৃহত্তম শহর হচ্ছে এই লাউক্কাই।
গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে উত্তর মিয়ানমারের একটি অংশ জুড়ে আক্রমণ শুরু করে এই অ্যালায়েন্স। এরপর ধারাবাহিকভাবে চীনের সঙ্গে সীমান্তে বেশ কয়েকটি শহর ও লাভজনক বাণিজ্যকেন্দ্র দখল করে তারা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার জান্তা যখন দেশটির নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল করে, তখন এটিকে ‘মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল’ বলে আখ্যা দিয়েছিল চীন। এরপর যখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
গৃহযুদ্ধ ও দেশটির সংখ্যালঘুদের ওপর দমন-নিপীড়নের জন্য আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে জান্তা। কিন্তু গত এক মাস ধরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং অভ্যুত্থানবিরোধী যোদ্ধাদের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত হতে দেখা যাচ্ছে।