গত তিন মাসে কমেছে ঋণখেলাপি, কারণ যা জানা গেল

তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমলেও ২০২২ সালের চেয়ে এখনো বেশি। ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচন, ঋণ পুনঃ তফসিল আর অবলোপনের কারণে খেলাপি ঋণ কমেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে দেশের চলমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ে ধীরগতি অব্যাহত আছে।

মোটা দাগে ঋণ পরিশোধে খেলাপিদের অনীহার কারণে বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণ ২০.৭০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায়। আর এই খাতে খেলাপি ঋণের অনুপাত এক বছর আগের ৮.১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৯ শতাংশ হয়েছে। এক বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ০.৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা এখন ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশ। এই হিসাবে অবশ্য এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বেড়েছে।

যদিও সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।

সেই হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ৯ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯.৯৩ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা আবার প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি।

মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেয়। যে কারণে প্রতিবছরই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমতে দেখা যায়। তা ছাড়া নির্বাচন ঘিরে খেলাপি ঋণ কমানোর ওপর প্রভাব রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও (আইএমএফ) খেলাপি ঋণ কমাতে শর্ত রয়েছে। সেই শর্ত পরিপালনে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই ব্যাংকগুলো আগে থেকেই খেলাপি ঋণ কমাতে প্রস্তুতি নিয়েছে। তারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। এই পথনকশা বা রোডম্যাপের মাধ্যমে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামানো হবে, যা এখন ৯ শতাংশে রয়েছে। আর রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, যা ডিসেম্বর শেষে যথাক্রমে ২০.৯৯ ও ৫.৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০.৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তিন মাসে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ১৬ কোটি টাকা।

গত বছরের শেষে তিন মাসে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বা ৭.০৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বা ৫.৯৩ শতাংশ। তিন মাসে কমেছে ১০ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকে ৮৫ কোটি টাকা কমে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪.৮২ শতাংশ। তবে বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩.৮৭ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রোডম্যাপ নিয়েছে। এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালকদের নীতিমালা কঠোর করা হয়েছে। যাতে ঋণ শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়। আর অডিট কমিটির চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র পরিচালকের মধ্যে থেকে থাকতে হবে। এতে করে অডিট কমিটির নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হবে। এসব পদক্ষেপের কারণে খেলাপি কমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণের স্থিতি রয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে। ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্র মালিকানাধী ব্যাংকের তিন লাখ ১৩ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের ৬৬ হাজার ৪৫৬ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪০ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।

আইএমএফের শর্ত মতে, পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকেও খেলাপি দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির হিসাবে খেলাপি দাঁড়াবে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। ব্যাংক খাতে প্রধান এ সমস্যা মোকাবেলায় ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বরং পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেলাপি নামের সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তাঁরা।