রাজশাহীর একমাত্র নারী হকার দিল আফরোজ খুকি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি হেঁটে পুরো শহরে সংবাদপত্র বিক্রি করছেন। তবে এখন অনেকটাই মানসিক ভারসাম্যহীন তিনি। এলোমেলো কথা বলেন। সব সময়ই থাকেন মারধরের আতঙ্কে। ভালো নেই তিনি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুকি ডেলিউশন রোগে আক্রান্ত। কাল্পনিক বদ্ধমূল ধারণায় তিনি অনুভব করেন, কেউ তাকে মারধর করছে। তার সুচিকিৎসা প্রয়োজন।
নগরীর শিরোইল এলাকার বাসার প্রবেশ পথে যেতেই দেখা হলো খুকির সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘মারবেন না তো? জানেন, রেন্টু আমাকে খুবই পিটিয়েছে।’ রেন্টু কে জিজ্ঞেস করলে খুকি জানালেন, তিনি রেন্টুকে চেনেনই না। তবে সারারাত তার ঘরের ছাদে রেন্টু ঘুমিয়ে থাকে। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই তাকে মারধর করে চলে যায়।

খুকি জানান, আগে পত্রিকা বিক্রি করে তার অনেক আয় হতো। ওই টাকায় অনেক দরিদ্র মেয়েদের সেলাই মেশিন, ছেলেদের সাইকেল কিনে দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতেই তিনি পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন।
সহকর্মী হকাররা জানালেন, খুকি সবসময় নগদ টাকায় পত্রিকা কেনেন। কখনও বাকি রাখেন না। তবে তিনি এখন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তার সুচিকিৎসা প্রয়োজন। রাজশাহী সংবাদপত্র শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি জামিউল করিম সুজন বলেন, খুকিকে নিয়ে আমরা গর্বিত। একজন নারী হয়েও তিনি ৩০ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে হাজার হাজার মানুষকে সংবাদপত্র পড়িয়েছেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ পেয়ে খুকির সব দায়িত্ব নিয়েছে জেলা প্রশাসন। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিল জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুকির দায়িত্ব নিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশনা পাওয়ার পর তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর ও প্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিয়েছেন বলে ডিসি জানান।
রাজশাহীর প্রবীণ সংবাদপত্র বিক্রেতা তসলিম উদ্দীন বলেন, খুকি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি অনেক সময় অনেক ভালো একজন হকারের বিরুদ্ধেও মারধরের অভিযোগ আনেন। আবার একটু পরই সুনামও করেন। কখন কী বলেন তার ঠিক নেই। তাকে শহরের সবাই চেনেন। তবে পত্রিকা নেওয়ার জন্য কাউকে কাউকে খুব জোর করেন। না নিলে মন খারাপ করেন।
খুকির ভাগিনা শামস উর রহমান রুমী জানান, জন্ম থেকেই খুকি প্রতিবন্ধী। ১৯৮৩ সালে প্রথম বিয়ে হয় লক্ষ্মীপুরে। তার অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে এক মাসের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। পরে ঢাকার ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে বিয়ে হয়। তবে দুই মাস পরই স্বামী মারা যান। ভাইবোনদের সঙ্গে থাকতে না চাওয়ায় তিন কাঠা জমিতে তাকে বাড়ি করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই আলাদা থাকেন। তবে তাকে মারধরের কথাগুলো সত্য নয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন বলেই তিনি এসব বলে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল হাসান সুফী বলেন, খুকিকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। ১৫ বছর আগেও তার মানসিক সমস্যা ছিল বলে জেনেছিলাম। কাল্পনিক বধ্যমূল ধারণায় তিনি মনে করেন তাকে কেউ মারছে। একে ডেলিউশন বলা হয়। এর সুচিকিৎসা আছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এ রোগের চিকিৎসা হয়।
রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দুনিয়া পত্রিকার কর্ণধার আহমেদ সফিউদ্দীন বলেন, ১৯৯১ সালে আব্দুল আজিজ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন খুকিকে একটা কাজ দিতে। খুকি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর অভাব-অনটন ও মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করতে চাইতেন। এ থেকে বাঁচাতেই তার কাজ দরকার ছিল। কিন্তু পত্রিকা বিক্রি ছাড়া তার জন্য উপযুক্ত কোনো কাজ আমার এখানে ছিল না। সেই থেকে তার হকারি জীবন শুরু।
সফিউদ্দীন বলেন, খুকি এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। নিঃসঙ্গ জীবনের হতাশা থেকে তিনি মানসিকভাবেও অসুস্থ। স্নেহ-ভালোবাসা এবং মমতার সঙ্গে তার চিকিৎসা জরুরি।